বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৯ অপরাহ্ন
লাইফস্টাইল ডেস্ক : সে অনেক কাল আগের কথা। ১৯৬৬-৬৭ সাল হবে। সেই সময় দিনে দুইবার সব ব্যস্ততাকে ‘বরফপানি’ খেলার মতো বরফ বানিয়ে ফেলতেন শাহাদাত হোসেন। কী করতেন? প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটায় সকাল সোয়া আটটা আর বেলা দুইটায় তিনি নিয়ম করে কান পাততেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। ‘আকাশবাণী কলকাতা’য় বসত অনুরোধের আসর। চারপাশের সবই যেন থেমে যেত, কেবল বাজত রবীন্দ্রসংগীত। বই পড়ার নেশাও ছিল। কলেজে থাকতেই পড়ে ফেলেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র। গান শুনে আর বই পড়েই নাকি শাহাদাতের মনের চোখ খুলে গিয়েছিল। তাই তো জীবনে কোনো দিনও ছবি তোলা না শিখেই এমন সবকিছুকে ক্যামেরায় বন্দী করেন, যেগুলোর দিকে চেয়ে থাকা যায় বেশ কিছুক্ষণ।
২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টায় মধ্যে আপনি যদি রাজধানীর বনানীতে ফ্যাশন হাউস কিউরিয়াস গ্যালারিতে যান, চোখে পড়বে বেশ কিছু ছবি। যে ছবিগুলো আপনার আশপাশেই থাকে, কিন্তু কখনো চোখ মেলে দেখেন না। এক পাশে রাখা বসির আহমেদ সুজনের সংগ্রহে থাকা বেশ কিছু পুরোনো ক্যামেরা। পাশেই আঁকা ক্যামেরার ইতিহাস। যিনি ছবি ভালোবাসেন, ক্যামেরাকে ঠিক যন্ত্র বলে মনে করেন না, তিনি এখানে এসে আর যা-ই হোক, ‘বোর খাবেন’ না।
প্রদর্শনীতে ঢুকতেই স্বাগত জানাল রবীন্দ্রনাথের গান। ‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…’। ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছি, একে একে বেজে চলেছে, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’। দেয়ালে টানানো নির্বাক ছবিগুলো আর ভেসে আসা রবীন্দ্রসংগীত, সবটাই হঠাৎ একটা বিন্দুতে যেন মিলে যায়। কখনো মনে হয়, এই আলো, এই সুর, বসন্তের পাতা, ফুল, দেয়ালের ছবি, কথা—সবাই মিলে কিছু একটা বলতে চাইছে। এমন দোলাচলেই আপনি দেখবেন ছবিগুলো। তাই তো এই প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত’।
শুরুতেই রয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া বিখ্যাত সব ছবি। সেগুলো পেরোলেই চোখে পড়বে আলোকচিত্র নিয়ে বিখ্যাত সব উক্তি। তারপর একে একে থমকে দাঁড়াবেন একেকটি স্থিরচিত্রের সামনে। ছবিগুলোকে ডাকা হচ্ছে ‘জলের আকাশ’, ‘অতলান্ত বিশ্রাম’, ‘শুভ্রতায় পদযাত্রা’, ‘অবনী বাড়ি আছো?’—এ রকম নানা নামে। ‘অবনী বাড়ি আছো’ ছবিটা একটা পাখির। দেখে মনে হবে, সে যেন তার প্রেমিকাকেই কৌতূহলী চোখে খুঁজছে গাছের ডালের কোটরে। এই পাখিটাকে দেখে এই আলোকচিত্রীর মনে পড়ে গিয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত এই কবিতা।
কয়েকটি ছবির কথা না বললেই নয়। চিচিঙ্গা আমরা অনেকেই চিনি। কিন্তু শাহাদাতের ছবিতে দেখা গেল, সেগুলো সাপের মতো জড়িয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে। এই আলোকচিত্রীর ভাষায়, ‘চিচিঙ্গাগুলোকে দেখে মনে হলো, আরে কিছু মানুষের মন তো ভেতর থেকে দেখতে এমনই!’ যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে তিনি তুলেছেন একটি কলার মোচার ছবি, সেখানে রোদে চিকিমিকি করছে নানা রং। বললেন, ‘কোথাও গেলে সেখানকার ইট, পাথর, রাস্তা, ভবন এগুলো আমাকে টানে না। আমার ভালো লাগে প্রাণ, প্রকৃতি আর রঙের খেলা। আমি তাই যেখানে যাই, ওগুলোই দেখি। আর আমি যে চোখে দেখি, সেটা আমি অন্যদেরও দেখাতে চাই। তাই সেটা স্থির করে ফেলার জন্যই ছবি তুলি।’
একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ধু ধু বরফ প্রান্তর। এর মধ্যেও বরফের ভেতর বেড়ে উঠছে একটা তরু। ছবিটাকে এই আলোকচিত্রী ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘চাইলে সমস্ত প্রতিকূলতার ভেতরেও নিজেকে বেড়ে উঠতে দেওয়া যায়, সবকিছুকে অতিক্রম করে সফল হওয়া যায়। এই ছবি আমার কাছে রূপক অর্থে মনের জোর হিসেবেই ধরা দিয়েছে।’ একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাহাড়, সমুদ্র আর আকাশ নানা রং হয়ে একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। চীনের একটি নদীকে হৃদয় হিসেবে কল্পনা করেছেন এই আলোকচিত্রী। একই দেশের হরবিন শহরে তুলেছেন বরফে তৈরি সুবিশাল সব স্থাপনার ছবি, যেগুলো কয়েক মাস পর গলে পানি হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় তোলা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় পড়ে রয়েছে একটি পালক। সেই পালকের ওপর আলো পড়ে চিকচিক করছে বেশ কয়েকটি রং। এই ছবি দেখে প্রদর্শনীতে আসা এক দর্শক বলেই ফেললেন, ‘এখানে এসে মনে হচ্ছে, অবহেলায় বা অসাবধানে যে মুহূর্তগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, সেগুলোকে সযত্নে ফ্রেমে পুরে ফেলা হয়েছে, যাতে এগুলোর সৌন্দর্য থেকে আমাদের মন বঞ্চিত না হয়।’
প্রদর্শনীটির কিউরেটর দেশের খ্যাতনামা ডিজাইনার চন্দ্রশেখর সাহা। প্রদর্শনী নিয়ে কিছুই বললেন না তিনি। কেবল এর আলোকচিত্রী সম্পর্কে বললেন, ‘শাহাদাত হোসেন এক আশ্চর্য মানুষ। তিনি অপূর্ব নিপুণতায় লক্ষ্মী আর সরস্বতী দুজনকেই খুশি করে চলেন। ব্যবসা আর শিল্প, দুটিকে দুই পকেটে নিয়ে পথ হাঁটছেন তিনি। অর্থ, বিদ্যা আর মন, এই তিনের অপূর্ব সংমিশ্রণে বিরল এক মানুষ শাহাদাত হোসেন।’
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply